জোবায়েদ আহাম্মদ মোমেন | সোমবার, ১২ নভেম্বর ২০১৮ | পড়া হয়েছে 1240 বার
চারদিকে গোলাগুলির তীব্র শব্দ। বৃষ্টির মত গুলি। সাথে আর্টিলারির ব্যাপক গোলাবর্ষণ। বারুদের গন্ধ, আর্তনাদ আর চিৎকার। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে মুক্তিযোদ্ধারা। রক্তক্ষয়ী বিভৎস এক যুদ্ধ।উত্তেজনাকর অনিশ্চিত এক পরিস্থিতি। এক পর্যায়ে শুরু হয়েছে হাতাহাতি যুদ্ধ, বেয়নেট চার্জ। ইংরেজীতে যাকে বলে “ডু অর ডাই”। “জয় অথবা মৃত্যু”। যে কোন একটি বেছে নিতে হবে। নায়েব সুবেদার শামসুল হকের প্রত্যয়ও তাই। বিজয় অথবা শহীদ। বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শত্রু সেনাদের ওপর। হত্যা করতে লাগলেন একের পর এক। পাকিস্তানীরা রাস্তা না পেয়ে নদীতে ঝাঁপ দিতে শুরু করল। যারা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে প্রান হারায়। সেদিন নদীর পানি রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল। এ ঘটনা কানাইঘাটের। ঘটেছিল ১৯৭১ সালের প্রথম সপ্তাহে।
সিলেটের কানাইঘাট এলাকা। অদূরে সুরমা নদী। ১৯৭১ সালে এখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত এক ঘাঁটি। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ঘটনা কানাইঘাট যুদ্ধ। এ যুদ্ধের একটি অংশের নেতৃত্ব দেন নায়েব সুবেদার শামসুল হক। জন্ম ব্রাহ্মনবাড়ীয়া জেলার নবীনগর উপজেলার বলিবাড়ী গ্রামে (জিনোদপুর ইউনিয়ন)।
কানাইঘাট যুদ্ধ ! আক্রমণের নির্ধারিত সময় ছিল ভোর রাত। শামসুল হক ও তাঁর সহযোদ্ধারা রাতের অন্ধকারে নি:শব্দে অবস্থান নিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের একেবারে কাছে। মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকটি দলে বিভক্ত। একটি দলের নেতৃত্বে শামসুল হক। সব দল যার যার অবস্থান নিয়েছে। এখন অধিনায়ক সংকেত দিলেই আক্রমণের পালা।
মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়ে উল্টো পাকিস্তানিরাই আক্রমণ করে বসল। ব্যাপকহারে গোলা এসে পড়তে লাগল শামসুল হকদের অবস্থানে। বিরামহীন ও ভয়াবহ গোলাবর্ষন, সাথে মূহুর্মূহু গুলি। অতর্কিত এই আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান বেশ নাজুক হয়ে পড়ে। কিন্তু বিচলিত হননি নায়েব সুবেদার শামসুল হক। তিনি নিজের জীবন বাজি রেখে সহযোদ্ধাদের মনে সাহস জুগিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করেন।সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন শামসুল হক। তাঁর প্রচেষ্ঠায় সহযোদ্ধারা পুনরায় সংঘটিত হয়ে সাহসের সঙ্গে পাল্টা আক্রমণ চালান। শুরু হয় প্রচন্ড যুদ্ধ।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয়ে বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকলেন। শামসুল হকদের রনমূর্তি দেখে পাকিস্তান সেনারা হতবাক হয়ে পড়ে। সকাল হওয়ার আগেই তাঁরা পাকিস্তান সেনাদের ঘেরাও করে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস, বীরত্ব ও কৌশলের কাছে শত্রুসেনারা হার মানতে বাধ্য হয়। সকালবেলা পাকিস্তানী সেনারা যুদ্ধ ফেলে পালানোর চেষ্ঠা করে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সেই সুযোগও দেয়নি। মু্ক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে অধিকাংশ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। বাদবাকী কিছু সৈন্য রাস্তা না পেয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয়। যারা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। অনেকে পানিতে ডুবেও মারা যায়। সকাল ১১টার মধ্যেই মুক্ত হয় কানাইঘাট।
১৯৭১ সালে শামসুল হক চাকরি করতেন পকিস্তানসসেনাবাহিনীতে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রথমে যুদ্ধ করেন ‘জেড’ ফোর্সের অধীনে। পরে ৪ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন। কানাইঘাট ছাড়াও ধামাই চা-বাগানের যুদ্ধে শামসুল হক অসাধারণ বীরত্ব পরিদর্শন করেন। মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও অনন্যসাধারণ নৈপূন্যের জন্যে বাংলাদেশ সরকার শামসুল হককে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করেন।
নবীনগরের এই সূর্য সন্তান ২৩শে মার্চ ২০১৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।
গ্রন্থনা : জোবায়েদ আহাম্মদ মোমেন।
তথ্য ঋণ:
> বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্র-১০ম খন্ড।
> বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৪।
> একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা- প্রথমা প্রকাশনী।
> খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা স্মারকগ্রন্থ- জনতা ব্যাংক।
> উইকিপিডিয়া
> মোহাম্মদ দস্তগীর। (নিউইয়র্ক প্রবাসী – মুক্তিযোদ্ধার ভাগ্নে)