জালাল উদ্দিন মনির | সোমবার, ১০ অক্টোবর ২০১৬ | পড়া হয়েছে 3949 বার
বিশ্ব সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের একজন ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ উপমহাদেশের ধ্রুপদী সঙ্গীত-সাধকদের অগ্রগন্য, শিল্পী ও মানুষ হিসেবে তিনি হয়ে আছেন অনন্য। একদিকে তাঁর অসাধারণ সৃজনসাধনা, অপরদিকে তাঁর একান্ত লোকায়ত আটপৌরে জীবনাচার, দুইয়ের মিলনে ব্যতিক্রমী হয়ে উঠেছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব। উত্তর ভারতের শিল্প-সমঝদার রাজপরিবারের আনুকূল্য তিনি লাভ করেছিলেন, ভ্রমণ করেছেন বিশ্বের নানা দেশ, সঙ্গীত-গুরু হিসেবে তালিম দিয়েছেন কালজয়ী শিক্ষার্থীদের, সুরবাদনে অগণিত মানুষের হৃদয় মাতিয়ে হয়ে উঠেছেন কিংবদন্তি। সেতার ও সানাই এবং রাগ সংগীতের গুরু হিসেবে সারা বিশ্বেই রয়েছে তার সুখ্যাতি। মূলত সরোদই তার শাস্ত্রীয় সংগীতের বাহন হলেও সাক্সোফোন, বেহালা, ট্রাম্পেটসহ আরও অনেক বাদ্যযন্ত্রের ওপর তার ছিল সমান দক্ষতা। রাজ দরবার থেকে বের করে রাগ সংগীতকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে গণমুখী করে তুলেছিলেন তিনি। মদিনা, মঞ্জুরী ও শোভাবতীসহ অসংখ্য রাগ সৃষ্টি করে গেছেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন। আজ ১০ অক্টোবর বিশ্ববরণ্য সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ১৩৫তম জন্ম দিন । জন্মদিনে তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।
বাবা আলাউদ্দিন খান নামে পরিচিত সুর সাধক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ১৮৮১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামের খাঁ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । আলাউদ্দিন খাঁর জন্ম বাংলা প্রদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে। তাঁর পিতা সাবদার হোসেন খান এবং মাতা সুন্দরী বেগম। স্থানীয় লোকেরা সাবদার হোসেন খানকে সাধু খান নামে ডাকতেন। তাঁর অপর দুই ভাই হলেন ওস্তাদ আফতাব উদ্দীন খান (তবলা ও বংশীবাদক) এবং ওস্তাদ আয়াত আলী খান (সুরবাহার বাদক)। পাঁচ ভাই দুই বোনের মধ্যে আলাউদ্দিন খাঁ ছিলেন তৃতীয়। ওস্তাদ আলাউদ্দীন খানের তবলায় হাতে খড়ি হয় তাঁর বড় ভাই ফকির আফতাবুদ্দীন খানের কাছে। একই সাথে তিনি তাঁর পিতার কাছে সেতারের তালিম নেন। দশ বছর বয়সে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে বরিশালের \’নাগ-দত্ত সিং\’ যাত্রাদলে যোগ দেন। তৎকালীন যাত্রাগানে বাংলার লোকসঙ্গীতের উপাদানে ভরপুর ছিল। যাত্রাদলের সাথে থাকার সময় তাঁর হার্মোনিয়াম, তবলা, বাঁশি, বেহালা, সারঙ্গী ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র এবং রাগসঙ্গীতের প্রাথমিক পর্যায়ের তালিম হয়েছিল। এক্ষেত্রে তাঁর প্রথম সঙ্গীত শিক্ষক ফকির আফতাবুদ্দীন খানের কাছে পাওয়া সঙ্গীতজ্ঞান বিশেষভাবে কাজে লেগেছিল কিন্তু যাত্রাদলের গান-বাজনা তাঁকে তাঁকে বেশিদিন পরিতৃপ্ত করতে পারে নি।
যাত্রাদলের সাথে ঘুরতে ঘুরতে তিনি কলকাতায় আসেন। এরপর বড় কোনো গুরুর কাছে তালিম নেবেন এই আশায়, যাত্রাদল ত্যাগ করে কলকাতায় ঘুরতে থাকেন। এই সময় তিনি বিভিন্ন মানুষকে গান শোনাতেন এবং একরকম ভিক্ষাবৃত্তি করেই জীবন নির্বাহ করতেন। এই অবস্থায় একদিন তিনি পাথুরিয়াঘাটার সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরকে গান গেয়ে মুগ্ধ করেন। পরে তাঁর গান শেখার ইচ্ছার কথা জানতে পেরে, সৌরীন্দ্রমোহন রাগসঙ্গীত শিক্ষার জন্য পণ্ডিত গোপালচন্দ্র চক্রবর্তী (নুলো গোপাল)-এর কাছে পাঠান। এই গুরুর কাছে তিনি ৭ বৎসর কণ্ঠসঙ্গীত, মৃদঙ্গ এবং উচ্চতর তবলা প্রশিক্ষণ নেন। সাত বৎসর এখানে শিক্ষাকাল কাটানোর পর, ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে প্লেগ রোগে পণ্ডিত গোপালচন্দ্র চক্রবর্তী মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তিনি কলকাতার \’স্টার থিয়েটার\’-এর সংগীত পরিচালক হাবু দত্তের কাছে যান―\’স্টার থিয়েটার\’-এর বাদ্যযন্ত্রী হওয়ার জন্য। হাবু দত্ত তাঁর সঙ্গীতে দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হন এবং থিয়েটারে যন্ত্রসঙ্গীত দলের সদস্য হিসাবে নেন। থিয়েটারে তিনি তবলা, মৃদঙ্গ ও সেতার বাজাতেন। এই সময় অন্যান্য যন্ত্রীদের কাছ থেকে তিনি বেহালা, বাঁশী ও পাখোয়াজ বাদনে পারদর্শী হয়ে উঠেন। পরে তিনি এই যন্ত্রদলে এসকল বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে খ্যাতি লাভ করেন। এর কিছুদিন পরে গিরিশচন্দ্র ঘোষ তাঁকে তবলা বাদক হিসাবে মিনার্ভা থিয়েটারে নিয়ে যান। এই সময় গিরিশচন্দ্র তাঁর নাম দিয়েছিলেন প্রসন্ন বিশ্বাস। এর পাশাপাশি তিনি কলকাতার মেছোবাজারের হাজারী ওস্তাদ নামক একজন সানাই বাদকের কাছ থেকে সানাই বাজানো শেখেন। এই সময়ে গোয়া থেকে আগত ফোর্ট উইলিয়ামের ব্যান্ডের ব্যান্ডমাস্টার লোবো’র কাছে ইউরোপিয়ান ক্লাসিক্যাল বেহালা বাজানো শেখেন।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা সঙ্গীত সম্মেলনে বাম থেকে পণ্ডিত কণ্ঠে মহারাজ (তবলা), আশিস খান (তানপুরা), ওস্তাদ আলী আকবর খান (সরোদ), ওস্তাদ আলাউদ্দীন খান (সরোদ) ও পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় (সেতার)।
বাঙালি সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দীন খান বিভিন্ন রাগ সৃষ্টি করেন। তিনি সংকীর্ণ রাগের উপর কাজ করতে পছন্দ করতেন। তাঁর সৃষ্ট রাগগুলো হলোঃ অর্জুন, ভগবতী, ভীম, ভুবনেশ্বরী, চণ্ডিকা, ধবলশ্রী, ধনকোষ, দীপিকা, দুর্গেশ্বরী, গান্ধী, গান্ধী বিলওয়াল, হৈমন্তী, হেম-বিহাগ, হেমন্ত ভৈরব, ইমনি মঞ্ঝ, জানুপুরী তোড়ি, কেদার মঞ্ঝ, কোমল মারওয়া, মদনমঞ্জরী, মাধবশ্রী, মাধবগিরি, মালয়া, মঞ্ঝ খামাজ, মেঘবাহার, মুহাম্মদ, নাত-খামাজ, প্রভাকলি, রাজ বিজয়, রাজেশ্রী, শোভাবতী, সুগন্ধা এবং সুরসতী। সেতার ও সানাই এবং রাগ সঙ্গীতে বিখ্যাত ঘরানার গুরু হিসাবে সারা বিশ্বে তিনি প্রখ্যাত। মূলত সরোদই তাঁর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বাহন হলেও সাক্সোফোন, বেহালা, ট্রাম্পেট সহ আরো অনেক বাদ্যযন্ত্রে তাঁর যোগ্যতা ছিল অপরিসীম। তাঁর সন্তান ওস্তাদ আলী আকবর খান ও অন্নপূর্ণা দেবী নিজস্ব ক্ষেত্রে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, ভারতীয় চিরায়ত সঙ্গীতের সাথে সম্পর্কিত সব ধরনের যন্ত্র তিনি কুশলতার সাথে বাজাতে পারতেন।
(ওস্তাদ আলাউদ্দীন খানের কাছে শিক্ষারতা অন্নপূর্ণা। দূরে অন্নপূর্ণা’র মা মদিনা বেগম।)
তাঁর শিষ্যদের দিকে তাকালে, বাদ্যযন্ত্রের সমাহার যে দেখা যায়, তাঁর বিচারে তাঁকে অতিমানবীয় গুণের অধিকারী বলে মনে হয়। আচার্যের বিখ্যাত শিষ্যরা হলেন পন্ডিত রবি শংকর, পন্ডিত নিখিল ব্যানার্জী, বসন্ত রায়, পান্নালাল ঘোষ সহ আরো অনেকে। আচার্য আলাউদ্দিন খান সাহেব নিজেও অনেক বিখ্যাত গুরু হতে দীক্ষা নিয়েছেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন কিংবদন্তীতুল্য ওস্তাদ ওয়াজির খান। তিনি তাঁর পুত্র ওস্তাদ আলী আকবর খানকে সরোদ, পণ্ডিত রবি শঙ্কর ও নিখিল বন্দোপাধ্যায়কে সেতার, কন্যা বিদুষী অন্নপূর্ণাকে সুরবাহার, পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষ ও বিজনাথ ঘোষ কে বাঁশি, পণ্ডিত রবীন ঘোষকে বেহালা শিখিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে এঁরা সবাই জগৎবিখ্যাত হয়েছেন।
গুণীশিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দীন খান ভারতীয় যন্ত্র সঙ্গীতের প্রতিটি ধারাতেই তাঁর সৃজনশীল হাতের ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ করেছেন। সংগীতের অসাম্য অবদানের জন্য ওস্তাদ আলাউদ্দিন একদিকে, যেমন সংগীত প্রেমিক জনগোষ্ঠীর গভীর ভালবাসা পেয়েছিলেন। অপরদিকে পেয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় ও বিভিন্ন সংগঠন থেকে বিরল সম্মান ও স্বীকৃতি। এগুলোর মধ্যে ১৯৫২ সালে হিন্দুস্তানী যন্ত্রসঙ্গীতের জন্য তিনি সঙ্গীত একাডেমী পুরস্কার, ১৯৫৮ সালে ভারতের রাষ্ট্রীয় খেতাব পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণ,এবং ১৯৬১ সালে বিশ্বভারতী থেকে ‘দেশীকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত হন। এ ছাড়াও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রদত্ত স্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি, দিল্লি একাডেমির সংগীত নাটক পুরস্কার ও ফেলোশিপ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সলিমুল্লা মুসলিম হলের আজীবন সদস্যপদ লাভ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই গুণীশিল্পী ভারতীয় যন্ত্র সঙ্গীতের প্রতিটি ধারাতেই তাঁর সৃজনশীল হাতের ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ বরেছেন। অথচ জীবনাচার ও জীবনদৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি সর্বদা থেকে গিয়েছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিবপুর গ্রামের সন্তান। আলাউদ্দিন খাঁর শিল্পসাধনা ও জীবনসাধনার গভীরতা উপলব্ধির জন্য তাই প্রয়োজন ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি।
১৯৭২ সালের ৬ নভেম্বর এই মহাসঙ্গীত সাধক পরলোক গমন করেন। আজ আজ ১০ অক্টোবর এই মহান সঙ্গীত সাধকের ১৩৫তম জন্মদিন, জন্মদিনে তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা ও ফুলেল শুভেচ্ছা।