মোঃ নিয়াজুল হক কাজল | সোমবার, ১০ অক্টোবর ২০১৬ | পড়া হয়েছে 3006 বার
আজ ১০ অক্টোবর। এদিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলাধিন বড়াইল ইউনিয়নের খারঘর গ্রামে সংঘটিত হয় ইতিহাসের নৃশংসতম, পৈশাচিক হত্যাকান্ড। সমগ্র জাতি আজ কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে,সেদিন যাঁরা যুদ্ধ করে হানাদারদের হাতে শহীদ হয়েছিলেন এবং গ্রামের নিরীহ মানুষ যাঁরা প্রাণ দিয়েছিলেন। পাকিস্তানি হায়েনা ও তাদের দালাল রাজাকারদের জাতি আজ ঘৃণাভরে ধিক্কার জানায়।
।। ফিরেদেখা ১০ অক্টোবর ১৯৭১।।
খারঘর মাজারের নিকট হানাদার বাহিণীর দু’টি লঞ্চ ভিড়লে স্থানিয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিবাহিণী পিছু হটলে হানাদার বাহিণী খারঘর গ্রামে ঢুকে নির্বিচারে গুলি করতে থাকে। গ্রামবাসী নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য এ গ্রামেরই মোমিনুল হক সুধনের বাড়ীতে জড়ো হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে হানাদার বাহিণীর ২১ জনের একটি দল বাড়ীটির চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে। হায়েনাদের এলোপাথারি গুলিতে সেখানে ১৮জন মারা যায় ও ৩০ জন আহত হয়। মোমিনুল হক সুধনের সারা শরীর বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। তিনি বর্তমানে পঙ্গু অবস্থায় জীবণযাপন করছেন। খারঘরে গণহত্যা চালানোর পর নরপিচাশের দল সকাল ১০টার দিকে বড়াইল বাজার পুকুর পাড়ের উত্তর দিক দিয়ে বাজারে প্রবেশের সময় আল মামুন সরকারের গেরিলা দলটির প্রতিরোধের মুখে পড়ে। দু’পক্ষের মধ্যে প্রচন্ড গুলিবিনিময় হয়। একপর্যায়ে হানাদার বাহিণী মুক্তিবাহিণীর দলটির উপর মর্টারের শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। শেলগুলি পানিতে পরার কারনে বিস্ফোরণ ঘটেনি। এ সম্মুখযুদ্ধে হানাদার বাহিণীর অনেক সদস্য হতাহত হয় এবং মুক্তিবাহিণীর আনসার সদস্য মোঃ আলী আজগর, রেনু মিয়া, খুরশিদ মিয়া, দারু মিয়া, রহিছ মিয়া, আবুল কাশেম শহীদ হন। গুলি শেষে খায়ের মিয়া ও গোলাপ মিয়া হানাদারদের হাতে ধরা পড়েন। তাঁদের হদিস পরে আর পাওয়া যায়নি। এছাড়া আরও বেশ কয়েকজন গ্রামের বিভিন্ন স্থানে হানাদারদের গুলিতে নিহত হন। পৈচাশিক তান্ডবের পর হায়েনার দলটি দুপুর নাগাদ খারঘর ত্যাগ করে। যোহর নামাজের পর পাগলা নদীর তীরে দু’টি বড় গর্ত করে একটিতে পুরুষ ও অন্যটিতে মহিলাদের মাটি চাপা দেয়া হয়।
হায়েনাদের হিংস্র আক্রমনে খারঘরে নিহত ৪৩ জনের নাম :
খারঘরের ফুল মিয়া পিতা হাফিজউদ্দিন,
রেনু মিয়া পিতা ফুল মিয়া,
আপজাউদ্দিন পিতা আলী নেওয়াজ,
সাজেদা বেগম পিতা ঐ,
আয়েশা পিতা আঃ মান্নান,
জোবেদা খাতুন পিতা আবু তাহের,
আঃ খালেক পিতা আঃ রহমান,
আলী আহম্মদ পিতা আব্বাস আলী,
দারু মিয়া পিতা আলী আকবর,
ফুল মিয়া পিতা আলী আকবর,
ফলফত আলী পিতা জগর মাহমুদ,
আলী নেওয়াজ পিতা মুন্সী ফজিল,
আঃ জলিল পিতা আছু মোল্লা,
খুরশেদ মিয়া পিতা চেরাগ আলী,
আবদুস ছাদির পিতা বলি মাহমুদ,
জজ মিয়া পিতা দারুগালী,
মতি মিয়া পিতা কফিলউদ্দিন,
সুরুজ মিয়া ঐ,
কামাল শাহ পিতা আঃ আজিজ,
অহিদ মিয়া পিতা বাদশা মিয়া,
আবুল কাসেম পিতা আঃ মজিদ,
সুফিয়া খাতুন স্বামী ইসমাইল মিয়া,
রোকেয়া বেগম পিতা আঃ মজিদ,
আবদুস সোবহান পিতা ভানু মিয়া,
রহিছ মিয়া পিতা আবদুস সোবাহান,
ওহাব আলী পিতা ইসহাক মিয়া,
কালা চান মিয়া পিতা হাফিজউদ্দিন,
ধন মিয়া পিতা গোলাম হোসেন,
মন্তু মিয়া পিতা অলফত আলী,
জাহের মিয়া পিতা আঃ করিম,
তৈয়ব আলী পিতা নেওয়াজ আলী,
ধনু মিয়া পিতা ফুল মিয়া,
লতু মিয়া পিতা মাতব্বর আলী গ্রাম বড়াইল,
আবুল কাশেম পিতা ইসমাইল মিয়া,
আবুল হোসেন ঐ,
আলেক মিয়া ঐ,
রহিছউদ্দিন পিতা ছব্দর আলী,
ফাতেমা বেগম পিতা রহিমউদ্দিন,
তঞ্জব আলী পিতা নোয়াব আলী,
নিজামউদ্দিন পিতা আবদুল মিয়া,
মালু মিয়া পিতা জয়দর আলী,
বালি মিয়া পিতা সুবেদার, গ্রাম জালশুকা,
আনু মিয়া আয়দার আলী গ্রাম বড়াইল।
২৪ এপ্রিল বড়াইল পাকবাহিণী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে একজন মহিলা সহ যোগেন্দ্র মোহণ ভৌমিক(৪৫), কৃষ্ণ ধন ভৌমিক(৪২), পরেশ কর্মকার(২৮), রাজমোহণ সুত্রধর(৪৪), হরেন্দ্র নাথ(৪১), অনিরুদ্ধ দেবনাথ(২০), ক্ষেত্র মোহন নাথ(৬৫), অমৃত নাথ(৪২)কে বন্দী করে আশুগঞ্জ নেয়ার সময় জাহাজেই তাদের হত্যা করে মেঘনা নদীতে ফেলে দেয়। পরদিন মহিলাটিকে ছেড়ে দিলে সে বড়াইল ফিরে এসে তার স্বামী তারা মোহণ দেবনাথ, ছয় ছেলে মেয়েকে নিয়ে ভারতে চলে যান। বাকীদের করুণ পরিনতির কথা গ্রামে এসে মহিলাটি বর্ণনা করেন। এ পরিবারটি আর গ্রামে ফিরে আসেনি।
১০ অক্টোবর নরপিচাশ হায়েনাদের বুলেটের আঘাতে খারঘর গ্রামের রীণা বেগম (৪) তাঁর মামার কুলে গুলিবিদ্ধ হলে নারিভুঁড়ি বেড়িয়ে যায়। বুলেটে ঝাঁঝড়া হয়ে রীণার মামা ঘটনাস্থলেই মারা যান। ইতিপূর্বে পিচাশের দল তাঁর নানাকেও মেরে ফেলে। তিনদিন পর্যন্ত তাঁর পেটটি গামছা দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল। তিনদিন পর শহর থেকে ডাক্তার এনে পেট সেলাই করা হয়। এ ক্ষতচিহ্ন নিয়ে রীণা বেগম এখনও বেঁচে আছেন। পেটের এ ক্ষতের জন্য তাঁর সংসার করা হয়নি। বর্তমানে তিনি অতিকষ্টে দিনযাপন করছেন। ইতিমধ্যে তাঁর পিতাও মারা গেছেন। রীণা বেমম (৪৮) এখন দ্ধারে দ্ধারে ধর্ণা দিচ্ছেন সহযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবার জন্য!
বড়াইল ও খারঘর এলাকায় অবস্থান গ্রহণকারী গেরিলা দলগুলি হল- আল মামুন সরকারের দল(স্থায়ী ক্যাম্প,বড়াইল), সেকশান কমান্ডার সারওয়ার্দি’র দল। মোঃতাজুল ইসলামে’র দল,মোঃ ইসহাক মিয়া’র দল,সৈয়দ মোবাশ্বের আলীর দল।
গ্রন্থনাঃ
মোঃ নিয়াজুল হক কাজল, সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সাংবাদিক।
লেখক ও গবেষক। নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
তথ্যসূত্রঃ
১/বড়াইল যুদ্ধকালিন স্থায়ি ক্যাম্পের ইনচার্জ-আল মামুন সরকার।(বর্তমান জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌরসভা চেয়ারম্যান)।
২/,৭১-এ বড়াইল যুদ্ধ এবং খারঘর গণহত্যার পটভূমি-কাজী ইমরুল কবির সুমন।