অনলাইন ডেস্ক | সোমবার, ২৩ মে ২০১৬ | পড়া হয়েছে 1529 বার
বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধিত সিম জালিয়াতি করে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় চট্টগ্রামে দুজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
মোবাইল অপারেটর রবির সিম ব্যবহার করে বিকাশ অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ জালিয়াতির এ ঘটনা ঘটেছে।
রোববার (২২ মে) বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, আপাতত রবির সিম ব্যবহার করে জালিয়াতির তথ্য পেয়ে আমরা দুজনকে আটক করেছি। গ্রামীণ ফোন, বাংলালিংক কিংবা ওয়ারিদের সিম ব্যবহার করেও একই ধরনের জালিয়াতি হচ্ছে কিনা সেটা আমরা তদন্ত করে দেখছি। আমরা মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোকে তাদের সিকিউরিটি সিস্টেম আরও কঠিন করার অনুরোধ জানাচ্ছি। অন্যথায় প্রযুক্তিভিত্তিক বহুমাত্রিক এই অপরাধ আরও বাড়বে।
বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধনের পরও জালিয়াতি করে রবি কোম্পানির মোবাইল সিম উত্তোলন করছে একটি প্রতারক চক্র। এর মাধ্যমে চক্রটি বিকাশ অ্যাকাউণ্টে জমা হওয়া সাধারণ গ্রাহকদের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
সম্প্রতি মোবাইল সিম নিয়ে জালিয়াতির এ চাঞ্চল্যকর তথ্য উদঘাটন করেছে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ। এ ঘটনায় বিকাশ-এর দুই এজেন্টকে আটকের পর তারা পুলিশকে দিয়েছে জালিয়াতির বিভিন্ন তথ্য। ভয়াবহ ধরনের এ জালিয়াতির ঘটনা উদঘাটন করে বিস্মিত খোদ পুলিশও।
আটক হওয়া দুজন হল, বান্দরবান জেলা সদরের এক নম্বর গলির বিকাশ এজেন্ট কুতুব উদ্দিন (৩১) এবং বিকাশ-এর সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার পরিবেশক কার্যালয়ের কর্মকর্তা মো.ফরহাদ (৩২)।
পুলিশের ধারণা, কুতুব ও ফরহাদ জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেয়ার পাশাপাশি জঙ্গিবাদি কর্মকাণ্ড এবং চাঁদাবাজির সঙ্গেও যুক্ত।
সংবাদ সম্মেলনে গ্রেফতার অভিযানে নেতৃত্বদানকারী জেলার সাতকানিয়া সার্কেলের সহকারি পুলিশ সুপার (এএসপি) একেএম এমরান ভূঁইয়া বলেন, বিকাশ অ্যাকাউন্টধারী কমপক্ষে ১২০টি বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধিত সিম জালিয়াতির মাধ্যমে উত্তোলন করেছে কুতুব ও ফরহাদ। তারপর সেই সিম ব্যবহার করে প্রকৃত বিকাশ অ্যাকাউন্টধারীদের লক্ষ লক্ষ টাকা তারা হাতিয়ে নিয়েছে।
যেভাবে শুরু জালিয়াতি
গত ২১ এপ্রিল সাতকানিয়া উপজেলার রঙ্গীপাড়া এলাকার বাসিন্দা নূরুন্নাহার বেগম থানায় গিয়ে অভিযোগ করেন, তার বিকাশ অ্যাকাউন্ট হিসেবে ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর (০১৮৫৯২২১৬২৮) আকস্মিকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি রবি সেবাকেন্দ্রে গিয়ে জানতে পারেন, তার সিমটি ইতোমধ্যে কুতুব উদ্দিন নামে তুলে নিয়ে গেছে। কুতুবও সিমটি বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন করেছে। পরবর্তীতে বৈধ মালিকানা প্রমাণের পর নূরুন্নাহার বেগমকে তার নম্বরসহ সিমটি ফেরত দেয়া হয়। সিম ফেরত নিয়ে তিনি জানতে পারেন, তার বিকাশ অ্যাকাউন্ট লগইন করে ২০ হাজার ৪’শ টাকা তুলে ফেলা হয়েছে। বিষয়টি জানতে পেরে তিনি পুলিশের দ্বারস্থ হন।
তদন্তে নামে পুলিশ
পুলিশের কাছে দেয়া অভিযোগে নূরুন্নাহার বেগম তার সিম তুলে ফেলার জন্য কুতুবউদ্দিনকে অভিযুক্ত করেন। অভিযোগের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্তের জন্য জেলা পুলিশের সাতকানিয়া সার্কেলের সহকারি পুলিশ সুপার (এএসপি) একেএম এমরান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে দেন এসপি একেএম হাফিজ আক্তার। তদন্ত এবং একইসঙ্গে গ্রেফতার অভিযান শুরু করে পুলিশ।
অভিযানে নেমে ২১ মে রাত ৯টার দিকে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার কেরাণীহাটে হক টাওয়ার থেকে কুতুব ও ফরহাদকে আটক করতে সক্ষম হয় পুলিশ।
জালিয়াতির মাধ্যমে ১২০ সিম উত্তোলন
আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে কুতুব ও ফরহাদ জানায়, তারা ২৪ মার্চ থেকে ১২ মে পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রায় ১২০টি বিকাশ অ্যাকাউন্টধারী প্রকৃত গ্রাহকের সিম জালিয়াতির মাধ্যমে একই নাম ও জাতীয় পরিচয়পত্র এবং আঙ্গুলের ছাপ ব্যবহার করে উত্তোলন করেছে। এর মধ্যে সাতকানিয়ার কেরাণীহাটের জিলানি টেলিকম থেকে ২৭টি, এসিপি টেলিকম থেকে ৬টি উত্তোলনের চেষ্টা করে ৩টি, মামুন স্টোর এণ্ড টেলিকম থেকে একটি সিম উত্তোলনের তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে পুলিশ।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া সার্কেলের সহকারি পুলিশ সুপার একেএম এমরান ভূঁইয়া বলেন, শুধুমাত্র নূরুন্নাহারে সিম তারা জালিয়াতি করে উত্তোলন করেছে তা নয়, মেডিকেলের ছাত্র, খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীসহ অনেক শিক্ষিত-সচেত লোকের সিমও তারা উত্তোলন করে নিয়েছে।
সাতকানিয়ার কেরাণীহাটের জিলানি টেলিকমের মালিক আব্দুর রউফ বলেন, ছবি-পরিচয়পত্র ও আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে একেকজন ৬০টিরও বেশি সিম উত্তোলন করেছে। শুধু আমার কাছ থেকেই ২০টি নিয়েছে। আমি ৬৭টি সিম উত্তোলনের তথ্য পুলিশকে দিয়েছি।
২০টি সিম একজনের কাছে বিক্রি করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গ্রামীণ, বাংলালিংক ও ওযারিদ অপারেটরে আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে একবার নিবন্ধিত সিম আরেকজনের আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে তোলার সুযোগ নেই। কিন্তু রবি অপারেটরে এখনও সেই বাধা নেই। এই সুযোগ ব্যবহার করে প্রতারকরা একাধিক সিম তুলে নিতে পারছে।
কিভাবে করে জালিয়াতি ?
আটক হওয়া কুতুবউদ্দিন বাংলানিউজকে জানায়, বিকাশ-এর এজেন্ট হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করার মধ্য দিয়ে সে জালিয়াতি করে সিম উত্তোলনের বিষয়টি শিখেছে। তারা শুরুতেই সাতকানিয়া-লোহাগাড়া উপজেলাকে টার্গেট করে, কারণ সেখানে অধিকাংশ প্রবাসী পরিবারের বিকাশ অ্যাকাউণ্ট আছে। তারা বিকাশ অ্যাকাউণ্টধারী প্রকৃত নম্বরের তালিকা বের করে দোকানে গিয়ে জানায়, সে ওই নম্বরের গ্রাহক। তার সিমটি হারিয়ে গেছে। হারিয়ে যাওয়া সিম সে পরিচয়পত্র, ছবি, আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে নিবন্ধন সম্পন্ন করে তুলে নেয়। নতুনভাবে সিম তোলার পর প্রকৃত গ্রাহকের আসল সিমটি অপারেটর কোম্পানি বন্ধ করে দেয়।
চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার একেএম হাফিজ আক্তার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রকৃত গ্রাহকের সিমটি যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন বিকাশ নম্বরের পিন কোড ব্যবহার করে প্রতারক চক্র অ্যাকাউন্টে জমা থাকা টাকা সহজেই তুলে নেয়। এভাবে অনেক গ্রাহককে তারা সর্বশান্ত করেছে। আমরা বিষয়টি খুব সিরিয়াসলি নিয়েছি। এ ধরনের জালিয়াতির সঙ্গে আরও কারা কারা জড়িত আছে সেটা আমরা তদন্ত করে দেখছি।
সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, অপারেটর প্রতিষ্ঠান রবি সম্ভবত এখনও তাদের সফটওয়্যার আপডেট করেনি। না হলে আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে সিম নিবন্ধনের পর সেই সিম আবার তুলতে গেলে তো ছাপ না মেলার কথা। তাহলে নিবন্ধিত সিম তুলতে পারল কিভাবে ? আর একজন কিভাবে ৫০-৬০টি সিম তুলতে পারল ? এক্ষেত্রে অপারেটরের দুর্বলতা আছে বলে আমরা মনে করি।
‘রবি কোম্পানিকে আমরা এ বিষয়ে সতর্ক হওয়ার অনুরোধ করছি। বাকি অপারেটরদের সিম নিয়েও এ ধরনের জালিয়াতি হচ্ছে কিনা আমরা খতিয়ে দেখছি। ’ বলেন এসপি।
সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) মোস্তাফিজুর রহমান এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদও উপস্থিত ছিলেন।