ডেস্ক রিপোর্ট| | মঙ্গলবার, ১২ এপ্রিল ২০১৬ | পড়া হয়েছে 3088 বার
বছর ঘুরে ফের আসছে পহেলা বৈশাখ। আর দু’দিন বাদেই শুরু হবে বাঙালির আবহমানকালের ঐতিহ্যবাহী এ উৎসব। তাই এ উৎসবকে সামনে রেখে পালবাড়িতে লেগেছে বর্ষবরণের রঙ। প্রতিটি বাড়ি সেজেছে বর্ণিল সাজে। আসন্ন বৈশাখী মেলার প্রস্তুতি ব্যস্ত করে তুলেছে পালপাড়ার কুমারদের। মেলাকে সামনে রেখে মাটির তৈরি খেলনা সামগ্রীসহ নানা ধরনের তৈজসপত্রের গায়ে তুলির শেষ আঁচড় দিতে ব্যস্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার ভোলাচং গ্রামের কুমারপাড়ার পালেরা। পাড়ার প্রতিটি বাড়িতেই এখন কাজের ধুম। ভোলাচং গ্রামের বাজার সংলগ্ন উত্তর পাশেই পালপাড়ার অবস্থান। ওই পাড়ায় ঢুকতে প্রথমেই প্রবীর চন্দ্র পালের বাড়ি। সরেজমিন ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মেলায় বিক্রির জন্য কুমার- কমুরিরা বাহারি ও হরেক রকম ডিজাইনের ছোট-বড় মাটির খেলনা ও তৈজসপত্র তৈরি করে উঠানে রোদে শুকাচ্ছেন। কেউ কেউ শুকিয়ে যাওয়া তৈজসপত্র উনুনে পোড়ানোর কাজে ব্যস্ত। আবার কেউ গাছতলায় বসে বিভিন্ন খেলনা সামগ্রীতে রঙ-তুলির আঁচড় দিচ্ছেন। পুরুষের পাশাপাশি এসব কাজে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করছেন পালবাড়ির নারীরা। প্রবীর চন্দ্র পালসহ পালপাড়ার অন্য বাসিন্দারা জানান,
এ গ্রামের কুমার সম্প্রদায়ের প্রায় ৫০ ঘর মৃৎ শিল্পের সঙ্গে নিয়োজিত। তবে আগের তুলনায় মাটির জিনিসপত্রের চাহিদা কমে যাওয়ায় তারা এখন ভালো নেই। এখন ব্যবসা আগের মতো লাভ হয় না। বংশ পরম্পরায় তারা এ কাজ করে গেলেও পরবর্তী প্রজন্ম কতদিন এ পেশা আঁকড়ে ধরে রাখবে এ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা পাড়ার প্রবীণদের। প্রবীর পালের পাশের বাড়িতেই গাছতলায় বসে রঙ আর তুলির আঁচড়ে খেলনা সামগ্রীকে নতুন রূপে রাঙিয়ে তোলার কাজ করছিলেন ষাটোর্ধ্ব গৌরাঙ্গ রৌদ্র পাল। তিনি জানান, মেলা শুরুর প্রায় ছয় মাস আগে থেকে চলে এ প্রস্তুতি। বিল থেকে নৌকা প্রতি মাটি কিনতে হয়
তিন-চার হাজার টাকায়। পরে মাটির দলা নরম করতে হয়। এরপর ফর্মার মাধ্যমে জিনিসপত্র তৈরি করে তারপর রং দিতে হয়। তবে এখন রঙের দামও বেড়ে গেছে, ফলে খুব বেশি লাভ হয় না। মৃৎ শিল্প নিয়ে আক্ষেপের শেষ নেই এ পাড়ার বাসিন্দা সন্ধ্যা রাণী পালের। তিনি বলেন, ‘বাপ-দাদারা কইরা
আইছে। এহন আমরাও করতাছি। কিন্তু আমরার ছেলে-পুলেরা এ পেশা আর টিকাইয়া রাখতে পারবো না’। কথা হয় প্রবীর চন্দ্র পালের ছেলে মহাদেব চন্দ্র পালের সঙ্গে। তিনি জানান, মেলা উপলক্ষে তাদের পাড়ায় খেলনা গরু, মহিষ, হাতি, ঘোড়া, হরিণ, খরগোশ, হাঁস, কবুতর, বক, টিয়া, মাছ, আম, পেঁপে ও মাছ আকৃতির ব্যাংক, ফুলের টব, হাড়ি-পাতিল, মাটির চুলা, বৌ পুতুলসহ হরেক রকম খেলনা সামগ্রী তৈরি করা হচ্ছে। একই পাড়ার হরি চন্দ্র পাল বলেন, এক সময় তাদের হাতেই তৈরি হতো ছাদের টালি, দইয়ের ছোবা, পানির কলস, রুটি তৈরির তাওয়া, পানের বাটা, হাড়ি- পাতিলের সরা, মালসাসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সামগ্রী। আট/দশ বছর আগেও উঠানে জায়গা হতো না। আগের মতো চাহিদা না থাকায় ওগুলো আর তেমন তৈরি করা হয় না। আগে পার্শ্ববর্তী নরসিংদী, কুমিল্লা, বাঞ্ছারামপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা আসতো বলে জানান হরি চন্দ্র পাল। এখনও পাইকাররা আসে তবে আগের তুলনায় অনেকটাই কম। পালদের দিনকাল নিয়ে কথা হয় ভোলাচং গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক মন্তোষ চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি বলেন, মৃৎ শিল্পের সঙ্গে এ পাড়ার যারা নিয়োজিত আছেন তাদের কারোরই জমি নেই, পুঁজি নেই। কেবল বৈশাখী মেলাকে সামনে রেখেই তাদের বেচা-কেনা ভালো হচ্ছে। পরে আর তারা পয়সার মুখ দেখেন না। সরকার যদি এ শিল্পীদের বিনা সুদে ঋণ দিতো তাহলে তাদের পক্ষে খুবই সুবিধা হতো। তাছাড়া পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হয়তো একদিন এ শিল্পটিই হারিয়ে যাবে।