এম কে জসিম উদ্দীন | সোমবার, ২২ আগস্ট ২০১৬ | পড়া হয়েছে 4418 বার
আমার বয়স যখন সত্র (সতের) তহন থেইক্কা রিসকার প্যান্ডেলে পাও যে লাগাইছি অহন পরযন্ত ইডা ছারতে পারিনাই। আনুমানিক পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স রিকসা চালক মোবারক হোসেনের । দেখে মনে হবে বয়স কবেই ষাট পেরিয়ে গেছে। কথা বলার সময় সে জানায়, বয়স পঞ্চাশ পারইতাছে অহনো এই জগতটা লইয়া আছি বাজান । ধনী গরিব ম্যালা মাইনসেরে আমি টানছি। অনেক শিক্ষিত মাইনসের জিবনে বড় হইছে এমুন গল্প হুনছি।
বত্রিশ বছর আগে বিয়ার পরে কসম কাটছিলাম যেবলা আল্লাহ পুলা মাইয়া দিব । হেরারে লেহাপরা করানের লাইজ্ঞা যা করনের সব করাম, দরকার অইলে দিন রাইত রিশকা চালামু। আমি চাইনা আমার মতন ভাইগ্য লইয়া তারা বাইচা থাহুক।
মোবারক হোসেন কথা বলার সময় টের পেলাম সে ভাবনাগুলোর মাঝে সে ডুবে গেছে। আমি যে তার সামনে বসা আছি হয়তোবা কিছু সময়ের জন্য অন্য জগতে বিচরন করায় সে তা ভুলে গেছে।
নবীনগর উপজেলার লাউর ফতেহ পুর ইউনিয়নের বাড়ীখলা গ্রামের বাসিন্দা মোবারক হোসেন । এলাকায় মোবারক নামেই সে পরিচিত । পঞ্চাশ পেরুনো মোবারক মিয়া রিকসা চালায় পয়ত্রিশ বছরের বেশী সময় ধরে । বিবাহিত জীবনে আজ সে পাঁচ সন্তানের জনক । তিন মেয়ে দুই ছেলে আর স্ত্রী নিয়ে মোবারকের সংসার । দু পায়ের জোরে তিন চাকার গাড়ির প্যাডেলে পা রেখে সে পাঁচ সন্তানের ভরন পোষণ করানো সহ তাদের পড়া লেখার খরচ যুগিয়েছে।
কতটা পরিশ্রম করলে একটা মানুষ সংসারের গানী টেনে গোটা পাচেক ছেলে মেয়ের লেখা পড়ার খরচ যোগান দিত তা মোবারক মিয়ার সাথে কথা বলে অনুমান করলাম। মোবারক মিয়ার সাথে অল্প সময়ে ৩৫ বৎসরের জমে থাকা রাগ, ক্ষোভ, অভিমান, চাপাকষ্ট, ব্যর্থতা সব কিছুই যেন শোনাতে চাইল। কঠোর পরিশ্রম করেও অর্থ কষ্টে দিন কাটাত মোবারক মিয়া। তার পরেও দমে যাননি তিনি।
চ্যালেঞ্জ গ্রহন করে কতটা সফল মোবারক মিয়া জানতে চাইলে আমি কোন উত্তর দিতে পারিনি। তবে মোবারক মিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল। বয়সের ভার তাকে কাবু করতে পারেনি, সেখানে চ্যালেঞ্জ কিভাবে তাকে হারাবে। বাবা তো তারাই যারা সন্তানের সুপথে এগিয়ে নিয়ে যান। আলোকিত হবার পথ দেখান। স্যালুট মোবারক মিয়াকে, আমার চোখে দেখা একজন শ্রেষ্ঠ বাবাকে।
জীবন সংগ্রামের ইতি ঘটবে কবে এর হিসেব নেই মোবারক মিয়ার। শুধু এটুকুই জানে আরো সামনে নিয়ে যেতে হবে সন্তানদের। অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে তাদের প্রথম সন্তান তানিয়াকে এইচ এস সি পাশ করিয়ে বিয়ে দিল ।
দ্বিতীয় সন্তান রুবেল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজীতে বিভাগে অনার্স ৩ বর্ষের ছাত্র ।
তৃতীয় সন্তান কাকলি আক্তার এই বছর নবীনগর সরকারি কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশ করলো ।
চতুর্থ সন্তান সবুজ মিয়া ব্যারিষ্টার জাকির আহাম্মদ কলেজে আসছে বছর এইচ এস সি পরীক্ষা দেবে
পঞ্চম সন্তান পলি আক্তার ব্যারিষ্টার জাকির আহাম্মেদ কলেজে একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী ।
সে বলে তার সব গুলো সন্তানই অনেক ভদ্র ও মেধাবী ।
জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত সে তার সন্তানদেরকে উচ্চ শিক্ষিত সৎ মানুষ ও দেশ প্রেমিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে নিজের কর্ম রিক্সা চালিয়ে যেতেও তার কোন আপত্তি নেই ।
সে চাই তার এই সন্তানেরা যেন পরিশ্রমী আর পরোপকারী হয় । তার মৃত্যুর পর মানুষ যেন বলে মোবারক সারা জীবন রিক্সা চালিয়ে পরিশ্রম করে কয়েকটা রত্ন রেখে গেছে । এতেই তার স্বার্থকতা।
বয়সের বাড়ে আজ সে অনেক দুর্বল হলেও সন্তানদের নিয়ে তার স্বপ্ন আজো যৌবনে দ্বীপ্তময় ।
বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সহ সমাজের আলোকিত মানুষগুলোর কাছে তার অনুরোধ তার অবর্তমানে তার এই চারা গাছগুলো যেন নষ্ট না হয় ।