জোবায়েদ আহাম্মদ মোমেন | বৃহস্পতিবার, ২৯ নভেম্বর ২০১৮ | পড়া হয়েছে 2056 বার
ঠাস ঠাস, দ্রিম দ্রিম শব্দে কেঁপে উঠে সিলেটের তেলিয়াপাড়া এলাকা। ১৯৭১ সালের ২রা ডিসেম্বর। রাত আনুমানিক ৮টা। হঠাৎ গুলাগুলির শব্দে রাতের নির্জনতা ভেঙ্গে পড়ে। পাক বাহিনী ও তার সহযোগী রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে অতর্কিত আক্রমণ করে। অন্ধকারে একসঙ্গে এক ঝাঁক অস্ত্রের গর্জন। আকস্মিক আক্রমণে মু্ক্তিযোদ্ধারা সবাই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। শত্রু একেবারে নাগালের মধ্যে চলে এসেছে। পাকিস্তানি সেনাদের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যায় মুক্তিযোদ্ধারা। এতে করে সেখানে এক বিশৃঙ্খল অবস্থায় সৃষ্টি হয়। এরকম অবস্থায় মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও সম্মুখযুদ্ধ বা হাতাহাতি যুদ্ধ ছাড়া আর কোন পথ খোলা থাকে না। হাবিলদার আব্দুস সালামও তাই করলেন। জীবনের মায়া ছেড়ে দুটি প্রতিজ্ঞা করলেন, ‘অন্তত ১০-১২ জন পাকিস্তানি শক্রুসেনাকে না মেরে মরব না’ এবং শত্রুর গুলি যদি লাগে, বুকে লাগবে কিন্তু পিঠে লাগতে দেবনা’। দ্রুত পজিশন নিয়ে চিৎকার করে বললেন “কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটবে না, যুদ্ধ চলবে, শেষ বুলেট পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে”। মুক্তিযোদ্ধারা যেন প্রান ফিরে পেল, আর ভাবার সময় নেই। যে যেভাবে পারলেন দ্রুত পজিশন নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালান। শুরু হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন মৃত্যুর লড়াই। শুরু হয়ে যায় এলএমজি আর রাইফেলের অবিরাম গোলাগুলি। রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধ। মৃত্যুভয় ঝেড়ে ফেলে বীরের মত লড়ে আব্দুস সালাম ও তাঁর সহযোদ্ধারা। সেদিন সামগ্রিক পরিস্থিতি মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে ছিলনা, তারপরও তাঁরা প্রাণপনে যুদ্ধ করতে থাকেন।
প্রায় দুই ঘন্টার এই সম্মুখ সমরে সালামসহ কয়েকজন যুদ্ধ করতে করতে পাকিস্তানি অবস্থানের কাছাকাছি চলে আসে। তাঁদের দু:সাহস ও বীরত্বে পাকিস্তানি সেনারা শেষ পর্যন্ত কোনঠাসা হয়ে পড়ে। যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা যখন ব্যাপক হারে হতাহত হচ্ছিল তখন তারা পালাতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় সন্নিকটে ঠিক তখনই হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া একটি শেল এসে পড়ে আব্দুস সালামের সামনে। মুহুর্তে ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল চারদিক। শেলের তপ্ত স্প্রিন্টারের আঘাতে তলপেট ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল আব্দুস সালামের। রক্তে ভেসে যায় তেলিয়াপাড়ার মাটি। এক সময় জ্ঞান হারালেন। আব্দুস সালামের রক্তেভেজা মাটির উপর দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেই শেষ পর্যন্ত তাঁর সহযোদ্ধারা ওই এলাকা দখলে রাখতে সক্ষম হয়। তেলিয়াপাড়ার যুদ্ধে আব্দুস সালাম ও তাঁর সহযোদ্ধারা যে অসম সাহস ও শৌর্যের সাথে লড়াই করেছেন, পৃথিবীর যে কোন বীরত্বব্যঞ্জক লড়াইয়ের সঙ্গে তার তুলনা হতে পারে। ওই সম্মুখ যুদ্ধে রাজাকার সহ ৩০ থেকে ৩৫ জন পাকিস্তানি সেনা মারা যায়।
আহত আব্দুস সালামকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে কলকাতায় পাঠানো হয়। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেও যুদ্ধের সেই ক্ষত আমৃত্যু বয়ে বেড়ান। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্বপূর্ন অবদানের জন্যে বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করেন। খেতাবের সনদ নম্বর ৯৮। প্রথম জীবনে পুলিশে চাকরি করা (পরে ইপিআর যোগ দেন), আব্দুস সালাম দারু মিয়ার পৈত্রিক বাড়ী ব্রাহ্মনবাড়ীয়া জেলার নবীনগর উপজেলার আলিয়াবাদ গ্রামে। নবীনগরের এই সূর্য সন্তান ২০১১ সালের ২৮শে ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধান্জলী।
গ্রন্থনা : জোবায়েদ আহাম্মদ মোমেন
তথ্য ঋণ:
>> বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্র।
>> বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস।
>> একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা- প্রথমা প্রকাশনী।
>> আব্দুল্লাহ জসিম- আলিয়াবাদ। (বাহরাইন প্রবাসী)